ইউরিক এ্যাসিডের কাজ এবং অতিরিক্ত ইউরিক এ্যাসিডের সমস্যা ও সমাধানের উপায় - বি পি আর সি হেল্থ সার্ভিস - প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর বি পি টি, এম ডি, এম পি এইচ, এম ডি এম আর, পি এইচ ডি
মানবদেহের প্রধান রেচন অঙ্গ হল কিডনী । এই কিডনীর মূল কাজ হল ছাকনির ন্যায় মানব শরীরের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ যেমন ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক অ্যাসিড ,অ্যামোনিয়া ইত্যাদি মূত্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে বের করা । এইসব পদার্থের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড একটি "পিউরিন" নামক রাসায়নিক পদার্থ ভেঙে তৈরি হয় । কিছুক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় ইউরিক অ্যাসিড রক্তে সঞ্চিত হলে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট এ স্ফটিক আকারে জমা হওয়ার ফলে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয় এবং এই ব্যথাই "গাউট" বা "গেটে বাত " নামে পরিচিত।
বর্তমানে অতিরিক্ত পিউরিন যুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যেই এই রোগ দেখা যায় । পুরুষদের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড এর স্বাভাবিক মাত্রা
3.4-7.0 mg এবং মহিলা দের ক্ষেত্রে
2.4-6.0 mg হওয়া উচিত । এই মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার ফলে জয়েন্ট লাল হয়ে ফুলে যায় আর ব্যথার জন্যে উঠতে বসতে অসুবিধা হয় ।
আধুনিক শহুরে জীবনে ইউরিক এসিড বৃদ্ধির সমস্যা অনেকেরই দেখা যায়। এর ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। একটু সচেতন হয়ে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনলে এবং পাশাপাশি লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করলে ইউরিক এসিড অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। আসুন জেনে নেওয়া যাক শরীরে ইউরিক এসিড বৃদ্ধিতে কী ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হবে এবং কি ধরনের
খাবার বাদ দিতে হবে।।
আমাদের শরীরে দুই ধরনের এমাইনো এসিডের প্রয়োজন পড়ে। একটি আবশ্যক (এসেনশিয়াল) এমাইনো এসিড। আরেকটি অনাবশ্যক (নন এসেনসিয়াল) এমাইনো এসিড। এই নন এসেনসিয়াল এমাইনো এসিডের মধ্যে একটি হলো পিউরিন। এই পিউরিন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে পাওয়া যায়। কারণ শরীরে পিউরিন তৈরি হয়।
এ ছাড়া কিছু কিছু খাবার থেকেও আমরা পিউরিন নামক এমাইনো এসিড পেয়ে থাকি। কোষে থাকা এই পিউরিনের ভাঙনের ফলে ইউরিক এসিড তৈরি হয়। আমরা যদি দেহের চাহিদার থেকে বেশি পরিমাণে প্রোটিন খেয়ে থাকি বা খাবারে যদি এলকোহল জাতীয় খাবারের পরিমাণ বেশি থাকে, তা থেকে দেহে পিউরিন নামক নন এসেনসিয়াল এমাইনো এসিড তৈরি হয়। এই পিউরিনের শেষ উৎপাদন (এনডপ্রডাক্ট) হিসেবে ইউরিক এসিড তৈরি হয়।
এই ইউরিক এসিড প্রথমে রক্তে চলে যায়। সেখান থেকে কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। রক্তে যদি ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায় এই অবস্থাকে বলা হয় হাইপারইউরিসেমিয়া। এই অতিরিক্ত ইউরিক এসিড সূক্ষ্ম স্ফটিক (ক্রিস্টাল) আকারে জয়েন্টের মধ্যে বিশেষ করে পায়ের আঙ্গুলে ব্যথা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া আমাদের দেহের শ্বেত কণিকা এই ইউরিক এসিড স্ফটিককে ফরেন বডি মনে করে আক্রমণ করে। ফলে বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হয় বা ফুলে যায়। এই অবস্থাকে টোফেস বলে।
প্রথম অবস্থায় শুধু পায়ে ব্যথা হয়। আস্তে আস্তে এর তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পা ফোলা, হাঁটু ও হাঁটুর জয়েন্টে ব্যথা হয়। ফলে ইউরিক এসিড আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটতেও সমস্যা হয়। হাইপারইউরিসেমিয়ার কারণে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন : বাত, কিডনিতে পাথর, কিডনি অর্কাযকর হওয়া, উচ্চরক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে।
হাইপারইউরিসেমিয়া বা ইউরিক এসিডে যেসব খাবার পরিহার করতে হবে
• অধিক চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়া যাবে না। যেমন : গরুর মাংস, খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস, মহিষের মাংস ইত্যাদি।
• অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জাতীয় মাংস (অর্গান মিট) খাওয়া যাবে না। যেমন : লিভার, কলিজা, মগজ, জিহ্বা ইত্যাদি।
• খোসাযুক্ত প্রাণী পরিহার করতে হবে। যেমন : চিংড়ি মাছ, শামুক, কাকড়া। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
• সব রকমের ডাল, বাদাম, মটরশুটি, সিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
·
অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করলে ইউরিক অ্যাসিড রোগ হতে পারে ।
·
এছাড়াও, মটন, চর্বি জাতীয় মাছ, মটর এবং অতিরিক্ত চা, চিনিযুক্ত পানীয়, কিডনি বিন, শুকনো মটর, বাঁধাকপি, মাশরুম এবং শুকরের মাংসে প্রচুর পরিমাণে পিউরিন পাওয়া যায় ।
• কিছু কিছু শাকসবজি খাওয়া যাবে না। যেমন : পালং শাক,পুঁই শাক, ফুল কপি ব্রকোলি, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ , পাকা টমেটো ইত্যাদি। এছাড়া মাশরুমও খাওয়া যাবে না।
• এলকোহোল, ক্যাফেন জাতীয় বেভারেজ খাওয়া যাবে না। যেমন : চা, কফি, কোমল পানীয়, কারো ক্ষেত্রে চকোলেট খাওয়া যাবে না।
• মিষ্টি ফলে ফ্রুকটোস থাকে যা ইউরিক এসিড স্ফটিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্ফটিককে বড় করে দেয়। তাই মিষ্টি ফল পরিহার করাই ভালো।
·
কিছু খাবার, বিশেষ করে ডাল, বিন, ছোলা আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে
হাইপারইউরিসেমিয়া বা ইউরিক এসিডে যেসব খাবারে বাধা নেই
• চর্বিহীন মাংস খেতে হবে। যেমন : মুরগির মাংস। মাছ, কুসুম ছাড়া ডিম পরিমাণ মতো খাওয়া যাবে।
• অধিক আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। যেমন : সবজি-শাক ইত্যাদি। এই আঁশ স্ফটিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শরীর থেকে মল আকারে বের হয়ে যায়।
• এন্টি অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমন : লেবু চা, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (পেয়ারা, আমলকি, কমলা, মাল্টা), গ্রিন-টি ইত্যাদি খেতে হবে।
• এই সময় চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে।
কারা ইউরিক এসিডে বেশি আক্রান্ত হন
• যাদের বংশে বাতের সমস্যা আছে তারা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
• যারা এলকোহল গ্রহণ করে।
• যারা প্রোটিন জাতীয় খাবার চাহিদার তুলনায় বেশি খেয়ে থাকে এবং শাক সবজি কম খায়।
• কিছু কিছু ওষুধ রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যেমন : ডাই ইউরেটিক মেডিসিন।
• যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, হৃদরোগের সমস্যা আছে তাদের ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
• যাদের ওজনাধিক্য রয়েছে তারাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
• যারা পানি কম পান করে তাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে উল্লিখিত শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
“গাউট” জনিত ব্যাথা নিয়ন্ত্রণকারী কিছু খাবারে আমাদের নজর রাখা দরকার যেগুলো হল:
·
ভিটামিন সি রক্তের ইউরেট স্ফটিক কণা বের করতে পারে ,তাই ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন আমলকি ,
মুসাম্বী ,কমলা লেবু ,পেয়ারা ,পাকা পেপে ,কিউই ,
সবুজ শাকসবজি এবং আপেল ইত্যাদি খাবারে রাখা প্রয়োজন । এছাড়া আপেল এর ম্যালিক অ্যাসিড ইউরিক অ্যাসিড বের করতে সক্ষম ।
·
কিছু “কমপ্লেক্স
কার্বস”যেগুলি কম গ্লাইসেমিক সূচক অর্থাৎ রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে যেমন গোটা খাদ্যশস্য (গম, ওটস, ব্রাউন রাইস ,
ভুট্টা, বার্লি, রাগি এবং বাজরা) এগুলি রোজকার খাবাররের তালিকায় রাখা প্রয়োজন ।
·
প্রোটীন জাত খাবারের মধ্যে কম ফ্যাট যুক্ত দুধ,ফ্যাটবিহীন প্রোটীন যেমন মটর, মটরশুটি, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া জরুরী । এছাড়া ডিমে পিউরিন এর পরিমাণ কম হওয়ায় রক্তে ইউরিক অ্যাসিড এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে ।
·
বিভিন্ন ফল ও সবজি ফাইবারজাত খাবার হিসেবে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড শোষণ করে কিডনির মাধ্যমে বের করতে সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করে ,সে কারণে কিছু ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন নাশপাতি,শসা,গাজর, বাদাম এবং বীজ(আমন্ড ,আখরোট ,তিল ইত্যাদি) খাওয়া প্রয়োজন ।
·
ছাড়া গ্রীন টী বা ডিক্যাফিনেটেড কফি ইউরিক অ্যাসিড এর মাত্রা হ্রাসে সাহায্য করে ।
About Prof. Dr. Md. Abu Saleh Alamgir
প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর বি পি টি (মেডিসিন ফ্যাকাল্টি – ঢাকা বিশ্ব
বিদ্যালয়), এম ডি (ফিজিওথেরাপি মেডিসিন –ইন্ডিয়া), এম পি এইচ ( পাবলিক হেল্থ এন্ড
নিউট্রিশন – এ আই ইউ বি), এম ডি এম আর (ডিজএ্যাবিলিটি এন্ড রি-হ্যাবিলিটেশন – ইউ
এন আই সি), পি এইচ ডি (ব্যাক-পেইন এন্ড স্পাইন কেয়ার – আমেরিকা)
প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর বাংলাদেশের প্রথম
এবং একমাএ ব্যাক-পেইন ও স্পাইন হেয়ার এবং
কাইরোপ্রাকটর, পাবলিক হেল্থ ও নিউট্রিশন এবং ডায়েট কাউন্সেলিং, ডিজএ্যাবিলিটি ও
রি-হ্যাবিলিটেশন এবং ফিজিক্যাল ফিটনেস বিশেষজ্ঞ সিনিয়র ফিজিওথেরাপি মেডিসিন
কনসালটেন্ট
প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর একজন বিশিষ্ট
ব্যাক-পেইন ও পেইন স্পেশালিস্ট, যিনি বিভিন্ন ধরণের সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি প্রয়োগ করে
নতুন, পুরাতন ও দীর্ঘ মেয়াদি বাত – ব্যথা, আর্থ্রাইটিজ ও প্যারালাইসিস রোগীদের
চিকিৎসা করেন।
প্রফেসর
ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর
বি পি
টি, এম ডি, এম পি এইচ, এম ডি এম আর, পি এইচ ডি
পাবলিক
হেল্থ ও নিউট্রিশন এবং ডায়েট কাউন্সেলিং বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র
ফিজিওথেরাপি মেডিসিন কনসালটেন্ট
কনসালটেন্ট
ফিজিওথেরাপি এন্ড বিভাগীয় প্রধান
ইসলামী
ব্যাংক হাসপাতাল, মতিঝির, ঢাকা
Comments
Post a Comment