ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ইতিহাস এবং অতীত ও বর্তমান এবং সম্ভাবনা - বি পি আর সি
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ইতিহাস
এবং অতীত ও বর্তমান এবং সম্ভাবনা
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা আধুনিক
চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি অন্যতম প্রধান ও অপরিহার্য় শাখা। ফিজিওথেরাপি একটি সমন্বিত
চিকিৎসা পদ্ধতি। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় একজন ফিজিওথেরাপি কনসালটেন্ট রুগীর রোগের অবস্থার
উপর ভিত্তি করে মেডিসিনের পাশাপাশি রোগ ভিত্তিক থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ বা বিভিন্ন প্রকার
ব্যায়ম, রোগের অবস্থার উপর ভিত্তি করে, রোগ ভিত্তিক থারমোথেরাপি বা বিভিন্ন প্রকার
মেশিনারীজ, রোগ ভিত্তিক এ্যাসিসটিভ ডিভাইছ বা সহকারী উপকরন এবং এ্যাডভাইছ বা উপদেশ
এর মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা রোগীকে প্রদান করে থাকেন।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শাখার
উপশাখা সমূহঃ-* মাসকিউলো-স্কেলিটাল ফিজিওথেরাপি * নিউরো-মাসকুলার ফিজিওথেরাপি * অর্থোপেডিকস
ফিজিওথেরাপি * নিউরোলজিক্যাল ফিজিওথেরাপি * স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি * পেডিয়াট্রিক ফিজিওথেরাপি
* জেরিয়াট্রিক ফিজিওথেরাপি * গাইনোকোলজিক্যাল ফিজিওথেরাপি * রেসপিরেটরি ফিজিওথেরাপি
* কার্ডিয়াক ফিজিওথেরাপি * সফ্ট টিস্যু ফিজিওথেরাপি * ভাসকুলার ফিজিওথেরাপি * ই এন
টি ফিজিওথেরাপি * আই সি ইউ ফিজিওথেরাপি * সি সি ইউ ফিজিওথেরাপি * এন আই সি ইউ ফিজিওথেরাপি
* পি আই সি ইউ ফিজিওথেরাপি * এইচ ডি ইউ ফিজিওথেরাপি * ডায়ালাইসিস ফিজিওথেরাপি * ব্যাক-পেইন
এন্ড স্পাইন কেয়ার ফিজিওথেরাপি * ফিজিক্যাল ফিটনেস ফিজিওথেরাপি * প্রি-অপারেটিভ এন্ড
পোস্ট-অপারেটিভ ফিজিওথেরাপি।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার জনক
পের হেনরিক লিং।যিনি সুইডেনে জম্ম গ্রহন করেন। পের হেনরিক লিং এর জম্ম ১৭৭৬ সালে এবং
মৃত্যু ১৮৩৯ সালে। যাকে সুইডেনে ‘ফাদার অব সুইডিশ জিমন্যাস্টিক’ও বলা হয়ে থাকে। ১৮১৩
সালে পের হেনরিক লিং রয়্যাল সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব জিমন্যাস্টিক স্থাপন করেন। যেখানে
পের হেনরিক লিং প্রথমে জিমন্যাস্টিকদের মাসকিউলো-স্কেলিটাল ও নিউরো-মাসকুলার জনিত সমস্যায়
সফট টিস্যু মোবিলাইজেশন, ম্যানিপুলেশন এবং থেরাপিউটিক এক্সারসাইজের মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসা শুরু করেন। পরবর্তীতে মোবিলাইজেশন, ম্যানিপুলেশন, থেরাপিউটিক এক্সারসাইজের
সঙ্গে
ম্যানুয়াল থেরাপি সংযুক্ত
করা হয়।এর পরবর্তীতে ফিজিওথেরাপিতে যুক্ত হয় হাইড্রোথেরাপি। এর পরবর্তী সময়ে ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসায় সংযুক্ত হয় ইলেকট্রোথেরাপি বা মেশীনারীজ। পরবর্তীতে সুইডেনের ন্যাশনাল বোর্ড
অব হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ১৮৮৭ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের অফিশিয়াল রেজিস্ট্রেশন
শুরু করে। পরবর্তীতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় নতুন করে সংযোজন হয় এ্যাসিসটিভ ডিভাইছ বা
বিভিন্ন সহকারী উপকরনের। এর পরবর্তী সময়ে ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসায় সংযুক্ত হয় রোগ
ভিত্তিক এ্যাডভাইছ বা বিভিন্ন প্রকার উপদেশ।
বহুবিধ তত্ব, তথ্য ও উপাত্ত
অনুসারে ১৮৯৪ সালে স্বয়ংসম্পুর্ন ভাবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থার যাএা শুরু হয়।
উন্নত দেশগুলোও তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। যেমন গ্রেট ব্রিটেনে ১৮৯৪ সালে চার্টার্ড
সোসাইটি অব ফিজিক্যাল থেরাপি গঠিত হয়। ১৯১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোতে
দ্য স্কুল অব ফিজিওথেরাপি চালু করা হয়। ১৯১৪ সালে রিট কলেজ আমেরিকাতে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা
কার্যক্রম চালু করা হয়। বিশ্ব উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং ১৯৮০-এর
দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও গবেষণার অনেক
উন্নয়ন সাধিত হয়। সমগ্র বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় উন্নয়নের
নজির রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসার লক্ষ্যে ফিরোজা বারি
হাসপাতালে প্রথম ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে
১৯৬১ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়। প্রফেসর ডাঃ আবুল হোসেন এর নেতৃত্বে।
কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ দিন ফিজিওথেরাপিতে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
নিয়ে ফিরে এলে তাঁর হাতে
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বিভাগের
গোড়া পত্তন হয়। শুরুতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার বিকাশ ছিল ধীরগতিতে। পরে স্বাধীনতা
যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের
পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব্ব হয়ে পড়ে অপরিসীম।
ব্রিটিশ ফিজিওথেরাপিস্ট মিস
ভেলোরি টেইলর ১৯৬৯ সালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। স্বাধীনতার পর
বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে ভেলোরি টেইলর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া
শুরু করেন
মার্কিন অর্থোপেডিক সার্জন
ডা. রোনাল্ড জে গার্স্ট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসে সরকারকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল
সাধারণ রোগীর
জন্য একটি অর্থপেডিক হাসপাতাল
করার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তৎকালীন সরকারের সহযোগিতায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের
চিকিৎসা শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও
পুনর্বাসনের জন্য জাতীয়
অর্থোপেডিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতালে
(নিটোর) ১৯৭২-৭৩ সালে প্রথম
ফিজিওথেরাপির ওপর ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি কোর্স বা শিক্ষা কার্য ক্রম চালু হয়। ২টি
ব্যাচ স্নাতক সম্পন্ন করার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর
স্নাতক কোর্সটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে শেরেবাংলা নগরে ২০০২ সালে অক্টোবর মাসে
প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয় জাতীয় অর্থপেডিপ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। ডা. রোনাল্ড জে নিটোর
গার্স্ট নিটোর-পঙ্গু হাসপাতালে কাজ শুরু করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে এবং বাংলাদেশের
চিকিৎসকদের ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ক্রমাগত অবহিত করেন। জাতীয়
অর্থপেডিপ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁর চেষ্টায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নতুন জীবন লাভ করে।
১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
মেডিসিন অনুষদের অধীনে ফিজিওথেরাপির উপর ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি কোর্সটি আবার
জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন
হাসপাতালে (নিটোর) শুরু হয় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে একই অনুষদের অধীনে বাংলাদেশ
হেলথ প্রফেশন্স ইনস্টিটিউটে
(বিএইচপিআই) কোর্স শুরু হয়। এরপর এই কোর্সটি পিপলস ইউনিভার্সিটি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়
(জিবি), স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্স, সাইক ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি, ইন্টারন্যাশনাল
ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স, ঢাকা ও রাজশাহী আইএইচটিতে চালু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের
প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি
ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি কোর্স চালু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার
'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল' স্বাধীনতা উত্তরকালে গণস্বাস্থ্য পুনর্বাসন
কেন্দ্র নামে জনহিতকর ট্রাস্ট হিসেবে
নিবন্ধিত হয়। গণস্বাস্থ্য
কেন্দ্র ট্রাস্টের উন্নয়নের নিমিত্তে প্রায় একত্রিশ একর ভূমি দখল করে দেয়া হয়। ১৯৯৪
সালে গণস্বাস্থ্য জনহিতকর ট্রাস্ট গণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। অর্থনীতিবিদ আনিসুর
রহমানের নেতৃত্বে ৩১ জন বুদ্ধিজীবী, প্রশাসক, সমাজসেবক ও অধ্যাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের
পরামর্শক্রমে প্রণীত রূপরেখায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ বিভাগ হিসেবে ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে ফিজিওথেরাপি
বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে নানা কারণে ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসার গুরুত্ব বাড়ছে।
প্রথমত, বর্তমান সরকারের
বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গড় আয়ু বাড়ার ফলে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০১১
সালের জনশুমারি অনুসারে দেশে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের মানুষের সংখ্যা ছিল ৭.৪৭ শতাংশ, তা
বেড়ে বর্তমান ২০২৪ সালে অস্টম জনশুমারি অনুযায়ী হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। অতীতে কেবল অবস্থাসম্পন্ন
পরিবারে বয়োবৃদ্ধ মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। বর্তমানে গ্রামে প্রায় পরিবারে একজন হলেও
বয়স্ক পুরুষ বা নারীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বড় কোনো ব্যাধি না থাকা সত্ত্বেও অনেকে অচল
হয়ে বাড়িতে বসে থাকেন। বয়স্ক মানুষের শরীরের নানা ধরনের ব্যথা, স্ট্রোক, মবিলিটি সমস্যা
এবং অসংক্রামক রোগ বাড়া প্রভৃতি কারণে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশগত ও পুষ্টিহীনতার
কারণেও প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।
তৃতীয়ত, যানবাহন বেড়ে যাওয়ায়
দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে। দুর্ঘটনায় সবাই মারা যান না, যাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁরা প্রতিবন্ধী
হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন। অন্যদিকে দুর্ঘটনায় যাঁরা বেঁচে যান তাঁরা হাসপাতালে সঠিক
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পান না। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু থাকলেও তা পরিপূর্ণ
নয়। কারণ, ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে এমবিবিএস চিকিৎসক , ডেন্টাল চিকিৎসক ও নার্সিং ছাত্র-ছাএীদের
কোনোরূপ জ্ঞান দেওয়া হয় না। ফলে ব্যান্ডেজ বা প্লাস্টার করে দীর্ঘদিন বিশ্রামে থাকার
কারণে মাংসপেশি শুকিয়ে যায় বা
জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়, যা
অনায়াসে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দ্বারা সচল রাখা যেত। এই তথ্য অনেক চিকিৎসকই জানেন না।
রেফারেল পদ্ধতির প্রচলন না থাকায় মেডিকেল ও ডেন্টালের কনসালটেন্টগন ফিজিওথেরাপি কনসালটেন্ট
এর কাছে রোগী রেফার করেন
না।
চতুর্থত, উন্নয়শীল রাষ্ট্রে
পরিণত হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারণেও দুর্ঘটনা এবং স্ট্রেস বাড়ছে।
পঞ্চমত, বর্তমানকালে সবচেয়ে
ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ফিজিওথেরাপি
একটি
কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা,
যা বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব দ্রুত
বাড়লেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এখনও প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে
নূ্ন্যতম দুইজন
করে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী
ফিজিওথেরাপি টিকিৎসকের পদ সৃষ্টি করেনি এবং নূ্ন্যতম সুবিধা ও সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়ে
ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার উপর চার বছরের থিউরি ও এক বছর ইন্টার্নশিপ
সহ
মোট পাচ বছরের বি পি টি বা
ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি কোর্স পাস করা আনুমানিক পাচ হাজার প্রফেশনাল ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক
আছে, যা বর্তমানে অষ্টম জনশুমারি ও গৃহগণনার ফলাফল অনুযায়ী প্রায় ২০ কোটি জনগোষ্ঠীর
চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাথাপিছু/জনপ্রতি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর সংখ্যা খুবই কম,
তাই বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে এক লাখ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের দরকার। প্রতিটি
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নূ্যনতম দু'জন ব্যাচেলর ডিগ্রি
প্রাপ্ত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ও পাঁচজন ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপি এ্যাসিটেন্ট এর প্রয়োজন
হবে।
বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে প্রায়
৫০ হাজার ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মেডিকেল
ও ডেন্টাল কলেজের ন্যায় ফিজিওথেরাপি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক তৈরি করে
দেশ এর বিশাল জনগোষ্ঠরি চাহিদা মিটিয়ে , বাহিরে প্রেরন করে বহু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের
সম্বাভনা রয়েছে এ খাতে। এমবিবিএস, বিডিএস এবং ফিজিওথেরাপি কোর্সে র ব্যাচেলর ডিগ্রিতে
উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য রয়েছে। এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথলজি এবং মাইক্রোবায়োলজি,
কমিউনিটি মেডিসিন, মেডিসিন, ফার্মাকোলজি প্রভৃতি মেডিকেলের মূল বিষয়ের সঙ্গে ফিজিওথেরাপিতে
আরও কিছু বিষয় যেমন কাইনেসিওলজি, ইলেকট্রোথেরাপি, থেরাপিউটিক এপারসাইজ, বায়োমেকানিক,
অর্থপেডিক মেডিসিন, নিউরো মেডিসিন, স্পোর্টস মেডিসিন, ফিজিওথেরাপি ইন কার্ডিওপালমোনারি,
ফিজিওথেরাপি ইন নিউরোলজি অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক, জেরিয়াট্রিক (বয়োবৃদ্ধদের সমস্যা), রিহ্যাবিলিটেশন
মেডিসিন, প্রস্থেটিক অ্যান্ড অর্থটিকস ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে হয়।
এই তিন কোর্সের ছাত্রদের
একই ল্যাবরেটরিতে কাজ শিখতে হয়, পাশাপাশি রোগীর সেবা দিতে হয়। তাছাড়া মেডিকেল কলেজের
একাধিক
সমৃদ্ধ লাইব্রেরি; এনাটমি,
ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথলজি যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ল্যাবরেটরিসমূহ ফিজিওথেরাপি
ছাত্রদের ব্যবহারের
সুযোগ রয়েছে।
ফিজিওথেরাপি বিভাগকে মেডিকেল
কলেজের বিভাগের সাথে সমন্বয় করে পরিচালিত করা হলে ছাত্ররা হাসপাতালের সুবিধাগুলো গ্রহণ
করতে পারবে এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার পাশাপাশি রেফারেল পদ্ধতির প্রচলন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার
মাধ্যমে প্রফেশনাল ও প্রশাসনিক সমন্বয় যেমন সহজ হবে, তেমনি একই রোগী হাসপাতালের সব
ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পাবে। এছাড়া ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা আলাদা হলে প্রতিষ্ঠানটি
একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে
মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। অপরদিকে মেডিকেল কলেজের সাথে সমন্বয় না করে আলাদা
ফিজিওথেরাপি কলেজ করা হলে নিম্নলিখিত অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে।
ক. শিক্ষকস্বল্পতা :সরকারি
ও বেসরকারি প্রায় সব মেডিকেল কলেজই শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে। আলাদা ফিজিওথেরাপি কলেজের
জন্য
মেডিকেল শিক্ষক সংগ্রহ অসম্ভব
হবে। বর্তমানে ভালো বিষয়ভিত্তিক ল্যাবরেটরির অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপিতে
উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই কম।
একমাত্র মাস্টারস অব ফিজিওথেরাপি কোর্স ২০০৮ সালে মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে প্রথম গণ
বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়, যোগ্য শিক্ষক এবং দক্ষ প্রফেশনাল তৈরি করার লক্ষ্যে সার্বিক
সহযোগিতা পেলে তবেই ভবিষ্যতে সে
প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা সম্ভব
হবে।
খ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণ
ব্যয়, হাসপাতাল পরিচালনা ও অন্যান্য কারণে ফিজিওথেরাপি কোর্স পরিচালনার ব্যয় অনেক বেড়ে
যাবে এবং এর ফলে ছাত্রদের শিক্ষা খরচও অনেক বেড়ে যাবে। বর্তমানে ৫ (পাঁচ) বছর মেয়াদি
ফিজিওথেরাপি ব্যাচেলর কোর্সের জন্য যেখানে প্রায় ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়, আলাদা প্রতিষ্ঠান
হলে এই ব্যয় বেড়ে ১০-১৫ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপি
এ্যাসিসটেন্ট এবং এক বছর মেয়াদি ফিজিওথেরাপি কেনিশিয়ানের প্রয়োজন রয়েছে।
২০১৮ সালে “বাংলাদেশ রি-হ্যাবিলিটেশন
কাউন্সিল” আইন মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে এবং এই আইনের মাধ্যমে রি-হ্যাবিলিটেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
স্বীকৃতি, রি-হ্যাবিলিটেশন সেবা, প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, রি-ঞ্যাবিলিটেশন পেশাজীবির
নিসন্ধন, সেবার মান নির্ারন ও নিশ্চিত করনের উদ্দেশ্যে এই আইন প্রনীত হয়। সারা বিশ্বে
স্পোর্টস মেডিসিনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা প্রথম কন্টাক্ট চিকিৎসক, অন্যান্য বিশেষায়িত
শাখা, যেমন স্পাইনাল ডিসফাংশন, মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিসফাংশন, নিউরো-মাসকুলার ডিসফাংশন,
কার্ডিও-ভাস্কুলার অ্যান্ড চেস্ট ডিজিজেস, নিউরোলজি এবং নিউরো সার্জারি, শিশুরোগ, প্রসূতি
ও স্ত্রীরোগ, অর্থোপেডিক মেডিসিন এবং অর্থোপেডিক সার্জারি ছাড়াও অন্যান্য শাখায়
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা সুনাম
ও সফলতার সঙ্গে চিকিৎসা করছেন। বিশেষ করে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসা সার্বক্ষণিক দরকার, তা প্রমাণিত। সুতরাং এই পেশাজীবন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।পাস করা ফিজিওথেরাপির চিকিৎসকেরা তাঁদের পেশাগত
অনুশীলন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলেন, ইতিমধ্যে পেশার স্বকীয়তা হুমকির মুখে পড়েছে
এবং ফিজিওথেরাপির শিক্ষার মান বজায় রাখা আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া কোনো
স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ, ধারাবাহিকভাবে পেশাদার বিকাশের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা ছিল না।
পেশাগত যোগ্য চিকিৎসকেরা নতুন পেশা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে কাজের সুযোগ
বা অনুশীলনের সুযোগ পাননি। এমনকি অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারেরাও রোগীকে ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসকদের কাছে রেফার করেন না।
এসব প্রতিকূলতা উত্তরণের
জন্য সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। ১৯৯৬ সালে ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন
ফর
ফিজিক্যাল থেরাপি ৮ সেপ্টেম্বরকে
বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিপিএ ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিস্বরূপ
গঠিত হয়েছে। বিপিএ ২০০৭ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের বৈশ্বিক সংগঠন বিশ্ব ফিজিওথেরাপি
সংস্থার পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করে। বিপিএ ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালন করে
আসেছে। ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন’ মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে
এবং এই আইনের মাধ্যমে রিহ্যাবিলিটেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি, রিহ্যাবিলিটেশন
সেবা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবীর নিবন্ধন ও সেবার মান নির্ধারণ
ও নিশ্চিত করণের উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণীত হয়েছে।
চলতি বছর বিশ্বের প্রায় প্রতিটি
দেশে ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির ২৫তম বর্ষ
পালিত
হচ্ছে। বিশ্ব ফিজিওথেরাপি
দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কোভিড-১৯-পরবর্তী পুনর্বাসন চিকিৎসা এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসকদের মুখ্য ভূমিকা’। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে কীভাবে একজন কোভিড-১৯-
এ আক্রান্ত ব্যক্তি আরোগ্য
লাভ করতে পারেন, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা দিকনির্দেশনা
দিয়ে সহায়তা
করবেন। অন্যদিকে, কোভিড-১৯
রোগে গুরুতর আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে পরিত্রাণ পেতে পুনর্বাসন
এবং
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা
অত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখকঃ প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু
সালেহ আলমগীর।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাএ
ব্যাক পেইন ও পাবলিক হেলথ এবং
ডিজএ্যাবিলিটি ও রি-হ্যাবিলিটেশন
বিশেষজ্ঞ সিনিয়র ফিজিওথেরাপি মেডিসিন কনসালটেন্ট
বি পি টি (মেডিসিন ফ্যাকাল্টি
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়),
এম ডি (ফিজিওথেরাপি মেডিসিন
– ইন্ডিয়া),
এম পি এইচ (আর সি এইচ – ব্যাক
পেইন),
এম ডি এম আর ( ডিজএ্যাবিলিটি
এন্ড রি-হ্যাবিলিটেশন – ইউ এন আই সি),
পি এইচ ডি (ব্যাক পেইন –
আমেরিকা)
পি জি টি অন নিউরো মেডিসিন
– পি জি হাসপাতাল,
অর্থোপেডিক মেডিসিন- সিরিয়াক্স-ট্রেইনড,
স্পোর্টস মেডিসিন –বি কে
এস পি,
স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি
–ইন্ডিয়া
ফেলো অন নিউরোলজিক্যাল রি-হ্যাবিলিটেশন
– ইন্ডিয়া,
ফেলো অন ইন্টারভেনশনাল পেইন
ম্যানেজমেন্ট- ইন্ডিয়া
মোবাইলঃ ০১৬৪১৫৭৬৭৮৭, ০১৭৩৮৩৯৪৩০৯
Comments
Post a Comment