কাউন্সেলিং কি, কাদের প্রয়োজন, কখন প্রয়োজন এবং কিভাবে কাউন্সেলিং করা হয় - বি পি আর সি
কাউন্সেলিং কি, কাদের প্রয়োজন, কখন প্রয়োজন
এবং কিভাবে কাউন্সেলিং করা হয়
কাউন্সেলিং বলতে কি বোঝায়ঃ
আমাদের জীবনে কখনও কখনও এমন সব বাধা আসে যেগুলোর জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত থাকি না বা তার মোকাবিলা করতেও সক্ষম হই না। ফলে আমাদের মধ্যে দিশাহারা বোধ, ক্লান্তি, রাগ, অসহায়তা, ভয়, হতাশা, দুঃখ, অক্ষমতা দেখা দেয়। সেই সময়ে এই পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলতে পারি না। আমাদের জীবন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই
অবস্থায় একজন মানুষকে যেই প্রক্রিয়ায় বা চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে পুর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে
আনা হয়, তাকে কাউন্সেলিং বলে। এই অবস্থায় কাউন্সেলিং-এর সহায়তায় একজন মানুষ তার জীবনের গোপনীয়তা রক্ষা করে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।
কাউন্সেলিং কাদের জন্যঃ কাউন্সেলিং সবার জন্যই জরুরি। বিশেষ করে আমরা যখন জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে দিশাহারা হয়ে যাই, তখন কাউন্সেলিং খুবই সাহায্য করে আমাদের। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা যা আমাদের নিজেদের ভালো করে চিনতে শেখায় বা বুঝতে শেখায়। আর সেই সঙ্গে আমরা যে বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মনে স্বচ্ছ ধারণার জন্ম দেয়। এর সাহায্যে আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বা বোধ গড়ে ওঠে, নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হয়ে উঠি এবং গঠনমূলক উপায়ে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে সক্ষম হই। কাউন্সেলিং আমাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন আনে, আমাদের আত্মনির্ভরতা ও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়। এসব কিছুই একজন মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহায়তা করে এবং জীবনের সার্থকতার সঙ্গেও এর গভীর যোগাযোগ রয়েছে।
অনেকসময়ে আমাদের সামনে কোনও জ্বলন্ত সমস্যা বা এমন চিন্তার আবির্ভাব হয় যার প্রতি মনোযোগ দেওয়া একান্ত দরকারি বিষয় হয়ে ওঠে। অনেক সময় অতীতের কোনও অভিজ্ঞতার প্রভাব আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতা, আচরণ এবং সম্পর্কের উপর পড়তে পারে। কখনও কখনও আমরা কোনও একটা বিষয় নিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি বা অনেক বেশি সংহত ও আত্মসচেতন হয়ে যাই। এক্ষেত্রে কাউন্সেলিং এমন একটা নিরাপদ বিষয় যেখানে অন্যের মতামত শোনানো হয় না। পরিবর্তে এর প্রভাবে আমরা আমাদের নিজেদের ভিতরের মানুষটাকে দেখতে পাই।
আমাদের জীবনে কখন কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন পড়েঃ এখানে এমনই কতগুলো ক্ষেত্রের কথা বলা হল যেখানে কাউন্সেলিং- এর সাহায্য একান্তই জরুরি হয়-
- সম্পর্কজনিত সমস্যা - পারস্পরিক
সম্পর্কের
দ্বন্দ্ব,
ভাঙন,
বৈবাহিক
ও পারিবারিক বিবাদ
- কঠিন অনুভূতির
সঙ্গে
মানিয়ে
নেওয়া
- রাগ,
ভয়,
উদ্বেগ,
যন্ত্রণা,
একাকিত্ব,
মানসিক
চাপ
- নির্যাতনের মোকাবিলা করা - শারীরিক,
যৌন,
মৌখিক
বা
মানসিক সমস্যা, স্বাস্থ্যগত
- গার্হস্থ্য হিংসার মোকাবিলা
করা, গার্হস্থ্য
হিংসা হতে পরিএান পাওয়া
- লিঙ্গ পরিচয়,
যৌন
সমস্যা
বোঝার
ক্ষেত্রে, মানসিক ভারসাম্ম হীনতা
দুর করা।
- জীবনের সন্ধিক্ষণ
ও প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করা - চাকরি,
বিবাহ,
স্বামী-স্ত্রীর আলাদা
হয়ে
যাওয়া,
বিবাহ
বিচ্ছেদ,
অভিভাবকত্ব,
বৃদ্ধ
হয়ে
যাওয়া,
কাজ
থেকে
অবসর
নেওয়া
- কর্মক্ষেত্রের সমস্যা - ব্যবস্থাপনার
সঙ্গে
দ্বন্দ্ব,
কৃতিত্ব,
কেরিয়ারের
আশা-আকাঙ্ক্ষা ও
সন্তুষ্টি,
হেনস্থা
- মানসিক অসুস্থতা
যেমন
- অবসাদ,
সিজোফ্রেনিয়ার
বিরুদ্ধে
লড়াই
করা
- শারীরিক অসুস্থতার
বিরুদ্ধে
লড়াই
করা এবং শারীরিক সুস্থতা ধরে
রাখা
- কোনও কিছুর
প্রতি
আসক্তি,
নিজের
ক্ষতি
করা
এবং
আত্মহত্যার
চিন্তার
বিরুদ্ধে
সংগ্রাম
করা
- মৃত্যু, প্রিয়
বস্তু
হারিয়ে
ফেলার
দুঃখের
সঙ্গে
মোকাবিলা
করা, স্বাভাবিক জীবন যাপন করা।
- মানসিক আতঙ্ক
ও অক্ষমতা কাটাতে
সচেষ্ট
হওয়া, মানসিক ভাবে সুস্থ ও
স্বাবাবিক জবিন যাপন করা।
- শারীরিক বা
মানসিকভাবে
অসুস্থ
কারোর
পরিচর্যার
কাজে
নিজেকে
মানিয়ে
নেওয়া
- শিশু ও
বয়ঃসন্ধিদের
সমস্যা-
আচরণগত
প্রতিবন্ধকতা,
লেখা-পড়া জনিত
চাপ,
পারিবারিক
বিবাদের
প্রভাব,
প্রিয়জনের
চাপ,
জোর জবরদস্তি
প্রভৃতি।
যখন আমরা কোনও সমস্যায় পড়ি তখন নিজেদের বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিন্তু তার পরিবর্তে কেন একজন কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি হয়ে ওঠে? একজন কাউন্সেলরের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি?
নিজেদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রায়শই একটা বড় সংখ্যক মানুষের একজন কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলার ঝোঁক ক্রমশই বাড়ছে। যদিও কাউন্সেলিং সম্পর্কে এখনও কিছু মানুষের মনে নানারকম বিধিনিষেধের বেড়াজাল বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অর্থাৎ কাউন্সেলিং-এর প্রতি তাদের মনে এখনও বিশ্বাস জন্মায়নি। এখনও মনে করা হয় যে কাউন্সেলিং অল্পবয়সি এবং বিপর্যস্ত মানুষ, দুর্বল মনের মানুষ এবং মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্যই প্রযোজ্য। অনেকে মনে করে কাউন্সেলিং-এর মধ্য দিয়ে মানুষকে পরামর্শ দেওয়া হয় এবং এর থেকে ভালো ব্যবস্থা হল পরিচিত কারোর সঙ্গে যেমন- কাছের বন্ধু বা পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা।
বন্ধু বা পরিবারের লোকেদের সঙ্গে আলোচনা অবশ্যই সাহায্য করতে পারে এবং বন্ধুরা যে পরামর্শ দেয় সেখানেও কোনও খারাপ উদ্দেশ্য থাকে না। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব বা মতামতের ঝুঁকি থাকতে পারে। অনেকসময়ে মনে হতে পারে নিজের সমস্যার কথা তাদের বলে তাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কখনও একজনের সমস্যার গভীরতা অন্যজনের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নাও মনে হতে পারে। তখন তারা নিজেদের মনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে অন্যের সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে পারে। একজন বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের কাছে তার কাছের মানুষের যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি শোনাটা কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে এবং সমস্যার সমাধানের উপায় ঠিক করার জন্য তাদের মানসিক অস্বস্তিতেও পড়তে হতে পারে।
এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলরের অবস্থান একেবারেই আলাদা, অনন্য। তারা কোনও অসুস্থ মানুষের বন্ধু বা পরিবারের সদস্য অথবা পরিচত কেউ নয়। একজন কাউন্সেলর মানুষের সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সম্পর্ক গড়ে, তাকে নিরাপদ রাখতে চায়, নিজের মতামত দেয় না এবং যখন কেউ তার সমস্যার কথা কাউন্সেলরকে বলে তখন কাউন্সেলর পুরো বিষয়টাই গোপন রাখে। এই কাজ করতে তাদের যতই কঠিন বা খারাপ লাগুগ না কেন, তারা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। কাউন্সেলর একজন প্রশিক্ষিত পেশাদার মানুষ। যাঁর একটা তাত্ত্বিক পটভূমিকা রয়েছে এবং বাস্তবে থেরাপির দক্ষতাও থাকে। রুগীর প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের দক্ষতা প্রয়োগ করেন। একজন কাউন্সেলর রুগীকে সহানুভূতি, সহযোগিতা দান করেন, তার গোপনীয়তা রক্ষা এবং প্রতিবন্ধকতা কাটানোর জন্য সঠিক রাস্তাও দেখান। এটাও মনে রাখা জরুরি যে কাউন্সেলিং করা মানে কোনও নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য পরামর্শ দেওয়া নয়। এর মাধ্যমে রুগীকে এমনভাবে উৎসাহ দেওয়া হয় যাতে সে নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারে। এভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার জন্য রুগীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলাও কাউন্সেলিং-এর সাহায্যে সম্ভব।
প্রত্যেক কাউন্সেলরের কাজ করার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি থাকে। কাউন্সেলিং-এর শুরুতেই সেই পদ্ধতির কথা তাঁর পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় প্রথমে কিছু সময় রুগির সমস্যার ধরন বুঝতে সময় লাগে। তারপর কাউন্সেলর ঠিক করেন কীভাবে কাউন্সেলিং করবেন। কাউন্সেলর রুগীর পারিবারিক পটভূমি, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তার শরীর স্বাস্থ্য সবকিছুই দেখেন এবং তারপর থেরাপির জন্য পদক্ষেপ করেন। ক্রমান্বয়ে কাউন্সেলর রুগীকে সঙ্গে নিয়ে থেরাপির প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় এবং লক্ষ্যে পৌঁছতে চেষ্টা করে।
একজন কাউন্সেলর কোনও চিকিৎসকের মতো দায়িত্ব পালন করে না। সে রুগির রোগ নির্ণয় বা তাকে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শও দেয় না। কাউন্সেলর মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পেশাদার যেমন- মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের সঙ্গে মিলে রুগির থেরাপির দায়িত্বও নেয়।
প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর
বি পি টি, এম ডি, এম পি এইচ, এম ডি এম আর, পি এইচ ডি
কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধানঃ ফিজিওথেরাপি মেডিসিন এন্ড
রি-হ্যাবিলিটেশন বিভাগ
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৬৪১৫৭৬৭৮৭, ০১৭৩৮৩৯৪৩০৯
Comments
Post a Comment