অতিরিক্ত ওজন কি, অতিরিক্ত ওজনের কারন, সমস্যা ও ওজন কমানোর উপায় - বি পি আর সি

 

অতিরিক্ত ওজন কি, অতিরিক্ত ওজনের কারন, সমস্যা ও ওজন কমানোর উপায়

শরীর সুস্থ রাখতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের নিজস্ব ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। সেই সাথে নানান ধরনের রোগ হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। অন্যদিকে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

ওজন কেন নিয়ন্ত্রণে রাখবেনঃ দেহের ওজন স্বাস্থ্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুস্বাস্থ্য বিভিন্ন রোগের পরিবেষ্টিত জালের কেন্দ্রে রয়েছে শরীরের ওজন।

ওজন সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো সুস্বাস্থ্যের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত তার মধ্যে রয়েছে

  • দেহের উচ্চতা অনুযায়ী ব্যক্তির ওজন
  • কোমরের মাপ তথা পেটে মেদের পরিমাণ 
  • ২৫ বছর বয়সের পর থেকে ওজন কেমন বাড়ছে

শরীরকে সুস্থ রাখতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের নিজস্ব ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। সেই সাথে নানান ধরনের রোগ হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। আবার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই সু-স্বাস্থ্যের জন্য ধূমপানমুক্ত থাকার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত ওজনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

অতিরিক্ত ওজনঃ অতিরিক্ত ওজন বা মেদাধিক্য বা ওবিসিটি হলো শরীরের এক বিশেষ অবস্থা, এই অবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত স্নেহ বা চর্বি জাতীয় পদার্থ জমা হয় এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে, ফলে আয়ু কমে যেতে পারে এবং একইসঙ্গে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বডি মাস ইনডেক্স হলো শরীরের উচ্চতা ওজনের আনুপাতিক হার, যা দিয়ে বোঝা যায় যে কোনো ব্যক্তি মাত্রাধিক ওজন বিশিষ্ট কিনা। যদি কারো বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ২৫ kg/m2 থেকে ৩০ kg/m2 মধ্যে থাকে তখন তাকে স্থুলকায় বা মোটা বলা যেতে পারে, আর যখন বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ৩০ kg/m2 বেশি থাকে তখন তাকে অতি স্থুলকায় বা অতিরিক্ত মোটা বলা হয়।

অতিরিক্ত ওজন সারাবিশ্বেই প্রধান সমস্যা। প্রতিটি মানুষের ওজনের তুলনায় কিছু পরিমাণ মেদ শরীরের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু শরীর উচ্চতার সাথে প্রয়োজনীয় ওজন কতটুকু হওয়া উচিত জানে না বেশীরভাগ মানুষই।

অতিরিক্ত ওজন একদিকে যেমন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে, অন্যদিকে মানসিক অশান্তি, অবসাদ আর হীনমন্যতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বে প্রতি বছর ২৮ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায় শরীরে অতিরিক্ত ওজনের কারণে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে জটিল অনেক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। হতে পারে ক্যান্সারও।

 

অতিরিক্ত ওজনের কারণঃ যদি কোনও মানুষের বডি মাস ইনডেক্স বা BMI ৩০-এর বেশি হয় তাহলে ধরে নিতে হয় সেই মানুষটি অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটিতে ভুগছেন।

 

. সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং অস্বাস্থ্যকর খাওয়া-দাওয়ার জেরে শরীরে বাড়তে থাকে মেদের পরিমাণ।

. বংশগত কারণে অনেকের মোটা হওয়ার প্রবণতা থাকে।

. হাইপো-থায়রয়েডিজমের রোগীরা থাইরয়েড হরমোনের অভাবে এবং প্রেডার উইলি, হলট ওরাম সিন্ড্রোমের রোগীরা জিনগত কারণে মোটা হয়ে থাকেন।

. অনিয়ন্ত্রিত ঘুম বা অতিরিক্ত চিন্তাও ওজন বাড়িয়ে দেয়।

. শারীরিক পরিশ্রম কম করলেও ওজন বাড়ে।

ওজন অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার আরও কিছু কারণ-

সবার ওজন একইভাবে বাড়ে না। কারও কারও ওজন বাড়তেই থাকে, কারও আবার থাকে স্থিতিশীল। তবে যাদের ওজনের কাঁটা ঊর্ধ্বমুখী, তাদের জন্য ভয়ের কারণটাও বেশি। কারণ জানেন তো, বাড়তি ওজনের হাত ধরেই চলে আসে নানা ধরনের অসুখ। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন শারীরিক সৌন্দর্য তো নষ্ট করেই, হয়ে দাঁড়ায় অস্বস্তির কারণও। শুধু যে বেশি খাবার খেলেই ওজন বেড়ে যায়, এই ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ অনেককেই দেখবেন, বেশি খেয়েও ওজন ধরে রেখেছেন। তবে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাসও ভালো নয়। সেটি হতে পারে ওজন বাড়ানোর একটি কারণ। বাকি কারণগুলো কী? জেনে নিন ওজন অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কিছু কারণ-

স্ট্রেসঃ জীবনে নানা ধরনের চাপ সামলেই আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। তাই স্ট্রেস আসা স্বাভাবিক। আর কারণেই অনেক সময় ওজন বেড়ে যেতে পারে। এর কারণ হলো স্ট্রেসের ফলে হরমোনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই অনেক সময় মানসিক চাপ বাড়লে, ওজনও অতিরিক্ত বেড়ে যায়।

ফ্লইড ইনটেকঃ শরীর ভালো রাখার জন্য কেবল ফ্লইড জাতীয় খাবার খান? এদিকে আবার পানি কম পান করেন? এগুলোও হতে পারে আপনার ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ। যখন আমাদের পেশী থেকে পানি শোষিত হতে শুরু করে, তখন শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। সেখান থেকে হয় কোষ্ঠকাঠিন্য হজমের সমস্যা। শরীরের সবকিছু ঠিক রাখার জন্য খেতে হবে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার। কোনো একটি খাবার খুব বেশি, কোনোটি কম খেলে চলবে না। শরীরের ঘাটতি পূরণের জন্য খেতে হবে সুষম খাবার। কম-বেশি হলেই শরীরে তৈরি হবে অসামঞ্জস্যতা।

পিরিয়ডে গরমিলঃ নারীর ক্ষেত্রে ওজন বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হতে পারে ঋতুস্রাবের গরমিল। পিরিয়ডের সময় কাছাকাছি এলেও কিছুটা ওজন বেড়ে যেতে পারে। আবার এই সময়ে সতর্কতার অভাবে শরীরে পানির ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। অনেক ধরনের পরিবর্তনই হতে পারে। তাই পিরিয়ডের সময়টাতে নিজের প্রতি যত্নশীল হোন।

খাওয়া এবং ঘুমে অনিয়মঃ এই কাজ বেশিরভাগ মানুষই করে থাকেন, খাওয়া এবং ঘুমের জন্য মানেন না কোন নিয়ম। এই অনিয়ম আপনাকে ফেলতে পারে ভীষণ বিপদে। যারা রাতে - ঘণ্টার কম ঘুমান, তাদের ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয় বেশি। তাই ঘুমের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন, সেইসঙ্গে প্রতিদিন একই সময়ে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

মেনোপোজঃ মেনোপোজ নারীর জীবনেরই একটি ধাপ। একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনোপোজ বলা হয়। এসময় হরমোনাল সমস্যার জন্য নারীর শরীরের ওজন অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে। সেখান থেকে কিংবা জাতীয় সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এসময় পুরো শরীরের হরমোন এলোমেলো হয়ে যায়। তাই মেনোপোজের সময় ওজন অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

অতিরিক্ত ওজনে বাড়ে যেসব রোগের ঝুঁকিঃ

. হৃদরোগের ঝুঁকিঃ বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে যে, কার্ডিয়ো-ভাসকুলার বিভিন্ন রকম সমস্যার সঙ্গে অতিরিক্ত ওজনের সম্পর্ক রয়েছে। অতিরিক্ত মেদ ধমনীর দেওয়ালে জমতে শুরু করলে, রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। ফলে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়তে থাকে।

. টাইপ ডায়াবেটিসঃ অল্প বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার নেপথ্যে সরাসরি যোগ রয়েছে অতিরিক্ত ওজনের। দেহের অতিরিক্ত মেদ থেকে ইনসুলিন ক্ষরণের পরিমাণ ব্যাহত হয়। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। রক্তে অনিয়ন্ত্রিত শর্করা অন্যান্য বহু রোগের ক্ষেত্রে অনুঘটকের মতো কাজ করে।

. ক্যান্সারের ঝুঁকিঃ স্তন, কোলন, কিডনি এবং অগ্ন্যাশয়ে ক্যান্সারের মত জটিল রোগ হতে পারে অতিরিক্ত ওজন থেকে। ডায়াবেটিস থেকে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার মতো লক্ষণ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

. লিভারের সমস্যাঃ নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হওয়ার পিছনেও অতিরিক্ত মেদের হাত রয়েছে। দেহে বাড়তে থাকা মেদ না পুড়লে, তা জমতে থাকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। লিভারে এই মেদ জমলে, সেখান থেকে প্রয়োজনীয় উৎসেচকের ক্ষরণের পরিমাণ কমে যায়। ফলে শারীর বৃত্তীয় প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। দীর্ঘ দিন ধরে এমনটা চলতে থাকলে প্রাণহানির ঝুঁকিও বাড়তে পারে।

. হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টঃ আমেরিকান লাং অ্যাসোসিয়েশন এর এয়ারওয়েস ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার নেটওয়ার্ক হাঁপানি ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি নিয়ে গবেষণা করে। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে অতিরিক্ত ওজনের সাথে যোগ রয়েছে হাঁপানির। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমেরিকার সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রল-এর পরিসংখ্যান বলছে, হাঁপানি নেই এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্থুলতায় আক্রান্ত মানুষ শতকরা ২৬. জন। আর হাঁপানির রোগীদের মধ্যে এই সংখ্যা শতকরা ৩৮. শতাংশ।

. বিষণ্ণতাঃ প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ওজন মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। ওবেসিটি প্রদাহ বাড়ায়, পাশাপাশি হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর জেরে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরতে পারে মানুষকে।

. অস্টিও-আর্থ্রাইটিজঃ দেহের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় বাড়লে চাপ পড়ে পায়ের জয়েন্টে। কারণ শরীরের সমস্ত ভার নিতে হয় পা কে। তখনই হাঁটু, নিতম্বে ব্যথা, জয়েন্টে যন্ত্রণার সমস্যা বেড়ে যায়। তাই অতিরিক্ত ওজনের জন্য অস্টিও- আর্থ্রাইটিজ হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

 

 

 

 

অতিরিক্ত ওজনের জন্য অনেকেই নিজের ওপর বিরক্ত। অনেক চেষ্টার পরও কিছুতেই কমছে না অনাকাঙ্ক্ষিত ওজন। অনেক ডায়েট এক্সারসাইজেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিকঠাক ডায়েট মেনে চললে নিজের ইচ্ছামত ওজন কমানো কোনও ব্যাপারই না।

ডিটক্স ডায়েট: সকালে এক গ্লাস গরম পানিতে লেবুর রস মধু দিয়ে শরবত বানিয়ে খেলে অথবা এক চা চামচ আদাবাটা দিয়ে খেলে ওজন হ্রাস পাবে। ডিটক্স ডায়েট হিসাবে সকালে শসাও খাওয়া যেতে পারে। শসার কয়েকটি স্লাইড, পুদিনা পাতা, এক চা চামচ আদা, খানিকটা বিট লবণ এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে পান করুন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নিজেই অনুভব করতে পারবেন পরিবর্তনটা। এছাড়া অ্যাপেল সাইডার ভিনেগারও খাওয়া যেতে পারে। এক গ্লাস পানিতে এক চামচ অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে খেলে অনেক উপকারে আসবে।

ব্রেকফাস্ট: ব্রেকফাস্টে ফাইবার সমৃদ্ধ ওটমিল রাখুন। ওটমিল ওজন কমানোর জন্য সবচেয়ে ভালো অপশন। এতে করে শরীরে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে কোলেস্টেরলও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। প্রতিদিন ওটস খেতে ভালো না লাগলে দুধ দিয়েও খেতে পারেন। বিকল্প হিসেবে রয়েছে প্যানকেক। এছাড়াও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ গ্রিন-টি দ্রুত মেটাবলিজম প্রক্রিয়ায় কাজ করে। যা সহজেই আপনার ওজন কমিয়ে আনবে।

লাঞ্চ ডিনার: দুপুর রাতে ভারী খাবারের তালিকায় ফাইবার, ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলস সমৃদ্ধ পুষ্টি উপাদান খাবার রাখুন। এক থেকে দেড় কাপ চালের ভাত, দুটো রুটি, এক বাটি ডাল, এক বাটি তরকারি এবং এক পিস মাছ বা চিকেন। মনে রাখতে হবে এসব খাবার যেন খুব বেশি স্পাইসি না হয়। বয়েলড ভেজিটেবল, ব্রাউন রাইস এবং গ্রিলড ফিশ খেতে পারলে আরও ভালো।

ইভিনিং স্ন্যাক্স: বিকেলে হালকা খাবারে এক মুঠো বাদাম, স্প্রাউটস, মুড়ি, ডাবের পানি বা ব্রাউন ব্রেড স্যান্ডুইচ গ্রিল করে খেতে পারেন। তবে যা কিছুই খান না কেন খাওয়ার পর এক গ্লাস পানি খেয়ে নিতে হবে। এতে পেট ভর্তি থাকলে ইম্পালসিভ ইটিং-এর সমস্যা হয় না। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পার্থক্য বুঝতে পারবেন।

বিএমআই এর পাশাপাশি যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেন

বিএমআই অতিরিক্ত ওজন নির্ধারণে কার্যকর হলেও সূচকটির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিএমআই এর সাহায্যে শরীরের মেদ (বডি ফ্যাট) বা চর্বির পরিমাণ হিসাব করা সম্ভব নয়।

তাছাড়া সূচকটির মাধ্যমে কেবল ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কি না সেটা জানা যায়। অতিরিক্ত ওজনের পেছনের কারণ কী অতিরিক্ত মেদ, মাংসপেশি না কি হাড়ের ওজন সে বিষয়ে পার্থক্য করা যায় না। তাছাড়া বিএমআই গণনায় বয়স লিঙ্গও বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

ফলে

  • শরীরে মেদের পরিমাণ কম হওয়ার পরেও পেশিবহুল কাউকে অতিরিক্ত ওজন বা স্থুল দলভুক্ত করা হতে পারে।
  • বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের মাংসপেশি কমে গেলেও এমন ব্যক্তিদের  ওজন স্বাভাবিক ধরা হয়, যদিও তারা অতিরিক্ত মেদভুঁড়ির অধিকারী হতে পারেন।
  • গর্ভধারণের কারণে ওজন বাড়ার ফলেও বিএমআই বেড়ে যায়। তাই সঠিক ফলাফল পেতে গর্ভবতী হওয়ার পূর্বের ওজন ব্যবহার করে বিএমআই হিসাব করা উচিত।

তবে এসব সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও তুলনামূলক সহজবোধ্য সুবিধাজনক একটি পদ্ধতি হিসেবে বিএমআই এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক থাকতে বিএমআই ছাড়াও অন্যান্য কিছু বিষয়ে ধারণা থাকা প্রয়োজন। নিচে এমন ৩টি বিষয় তুলে ধরা হলো

. পেটের মেদ নিয়ে সতর্ক থাকুন

বাড়তি ওজনের পাশাপাশি পেটের মেদও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অতিরিক্ত ভুঁড়ি থাকলে হৃদরোগ, টাইপ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল ব্রেইন স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কয়েক বছরের মধ্যে পেটের মেদ - ইঞ্চি বেড়ে গেলে সেটাও শঙ্কার কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার দৈনন্দিন খাবারের অভ্যাস শারীরিক পরিশ্রম নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত।

অতিরিক্ত মেদ কেন ক্ষতিকর

গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরে অতিরিক্ত মেদ হলে সেটি সাধারণত পেটের মাঝের অংশে (নাভির চারিদিকে) জমা হওয়ার প্রবণতা থাকে। শরীরের অন্যান্য স্থানের মেদের তুলনায় পেটের মধ্যে জমা হওয়া চর্বি বা মেদ থেকে বিভিন্ন হরমোন কেমিক্যাল তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এসব হরমোন কেমিক্যাল আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। ওজন বিএমআই স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলেও কেবল পেটের অতিরিক্ত মেদের কারণে বিভিন্ন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সাড়ে লক্ষ নারী-পুরুষের ওপর বিএমআই পেটের মেদের সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণায় করা হয়। সেখানে দেখা যায়, একই বিএমআই এর দুজন ব্যক্তির মধ্যে যার পেটের মেদ বেশি তার অকাল মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

কোমরের মাপ কীভাবে নিতে হয়

এই মাপ নেওয়ার পদ্ধতিটি জামাকাপড় তৈরির সময়ে কোমরের মাপ যেভাবে নেওয়া হয় তা হতে আলাদা। নিচের পদ্ধতিতে আপনি সঠিকভাবে পেটের মাপ নির্ধারণ করতে পারেন। এজন্য একটি মেজারিং টেপ বা মাপ নেওয়ার ফিতা ব্যবহার করতে হবে।

নিচের তিনটি ধাপ অনুসরণ করে আপনি সহজেই কোমরের মাপ বের করতে পারবে

. কোমরের দুই দিকে আলতো করে চাপ দিয়ে আপনার হিপ বোন বা কোমরের হাড়ের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট খুঁজে বের করুন।

. এবার বড় করে একটি শ্বাস নিয়ে নিঃশ্বাসটি স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে দিন।

. এই অবস্থায় বের করা পয়েন্টের ঠিক উপর বরাবর মেজারিং টেপ দিয়ে কোমরে ফিতা পেঁচিয়ে মাপ নিন।

বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে কোমরের হাড়ের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্টটি নাভি বরাবর থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে পয়েন্টটি আরেকটু নিচে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে মাপ নেওয়ার সময়ে ফিতাটি নাভির আরেকটু নিচে নামিয়ে কোমরের হাড়ের ঠিক ওপরে ধরতে হয়।

ফিতা ধরার সময়ে দুটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে

  • বেশি আঁটসাঁট অথবা ঢিলেঢালা না হয়
  • ফিতা যাতে মেঝের সমান্তরালে থাকে

কোমরের মাপ কত হওয়া উচিত

আপনার উচ্চতা, ওজন অথবা বিএমআই যতই হোক, পেটে অতিরিক্ত মেদ থাকলে তা সঠিক খাবার তালিকা নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে কমিয়ে ফেলতে হবে। কমিয়ে ফেলা ওজন পেটের মেদ যেন ফিরে না আসে সে উদ্দেশ্যে একটি সুস্থ জীবনধারা মেনে চলা উচিত। হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কোমরের মাপ কত হওয়া উচিত তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

নারীদের ক্ষেত্রে

৩১. ইঞ্চি বা ৮০ সেন্টিমিটারের নিচে

পুরুষদের ক্ষেত্রে

৩৭ ইঞ্চি বা ৯৪ সেন্টিমিটারের নিচে

পেটের মাপ এই সীমা অতিক্রম করলে ওজন মেদভুঁড়ি কমিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

ছাড়া এই মাপ যদি নারীদের ক্ষেত্রে ৩৪ ইঞ্চি (৮৮ সেমি) এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪০ ইঞ্চি (১০২ সেমি) অথবা এর চেয়েও বেশি হয়, তাহলে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

. কোমর নিতম্বের অনুপাত

কোমর নিতম্বের অনুপাত ইংরেজিতে ওয়েস্ট টু হিপ রেশিও  হিসেবে পরিচিত। পেট বা কোমরের মাপকে নিতম্বের মাপ দিয়ে ভাগ করে এই অনুপাত হিসাব করা হয়। বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি সম্বন্ধে ধারণা পেতে অনুপাতটি বেশ কার্যকর।

পুরুষদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত .৯০ এর বেশি এবং নারীদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি .৮৫ এর বেশি হওয়া অনুচিত। অনুপাতটি এই সীমার উপরে যাওয়া বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি নির্দেশ করে।

কোমর নিতম্বের অনুপাত নির্ণয় করার পদ্ধতি তেমন কঠিন নয়

. প্রথমে উপরের পদ্ধতিতে কোমরের মাপ বের করুন

. এবার নিতম্বের সবচেয়ে চওড়া জায়গা বরাবর টেপ পেঁচিয়ে মাপ নিন

. এই মাপ দিয়ে কোমরের মাপকে ভাগ করুন

তবে আপনার কাছে যদি হিসাবটি জটিল মনে হয়, তাহলে কেবল কোমরের মাপ ব্যবহার করেই কার্যকরভাবে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয় করা যাবে।

. বডি ফ্যাট পারসেন্টেজ

এটি দ্বারা শরীরের মোট চর্বির শতকরা পরিমাণ জানা যায়। সেই সাথে কিছু কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের কোন অংশে কতটুকু মেদ আছে সেটিও বের করা যায়। কোমরের মাপ কোমর নিতম্বের অনুপাত এই পরিমাপের অন্তর্ভুক্ত। ছাড়াও যেসব উপায়ে শরীরে মেদের পরিমাণ (বডি ফ্যাট) হিসাব করা যায় তার মধ্যে রয়েছে

স্লাইড ক্যালিপার্স

এই পদ্ধতিতে সহজ কম খরচে শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশের মেদ পরিমাপ করা যায়। তবে এই পদ্ধতি শরীরের মোট মেদের অনুপাত নির্ণয়ের থেকেও একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কী পরিমাণ মেদ আছে তা পর্যবেক্ষণ করতে অধিক কার্যকর। তাছাড়া পদ্ধতিটি ব্যক্তিনির্ভর। যেমন: স্থুল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটি তেমন কার্যকর নয়।

বায়ো ইম্পিডেন্স

এই পদ্ধতিতে সহজেই খুব দ্রুত শতকরা মেদের পরিমাণ নির্ণয় করা যায় এবং সাধারণত বেশ সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়। 

ডেক্সা স্ক্যান

ডেক্সা স্ক্যানকে শরীরের মেদসহ বিভিন্ন গাঠনিক উপাদানের অনুপাত নির্ণয়ের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। পদ্ধতিটি এক্স-রের মাধ্যমে মেদের অনুপাত, হাড়ের ঘনত্ব মেদমুক্ত টিস্যুর অনুপাত হিসাব করে।

ডেক্সা স্ক্যানের মাধ্যমে দ্রুত নিরাপদ উপায়ে সঠিক নির্ভরযোগ্য হিসাব পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে আপনি শরীরে মোট মেদের অনুপাতের পাশাপাশি কোন স্থানে কী পরিমাণ মেদ জমে আছে সেটাও জানতে পারবেন।

তবে এই পদ্ধতিটি ব্যয়বহুল। একটি স্ক্যান করাতে ১২ হাজার টাকা অথবা এর চেয়েও বেশি খরচ হতে পারে।

ওজন কমানোর কার্যকর উপায়

খাবার থেকে আমাদের দেহে জমা হওয়া শক্তি বা ক্যালরির পরিমাণ যখন প্রতিদিন খরচ হওয়া শক্তির চেয়ে বেশি হয় তখনই ওজন বাড়ে। ফলে অতিরিক্ত ওজন স্থুলতার মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। তাই ওজন কমাতে প্রয়োজন একটি সুস্থ জীবনধারা।

নিজে নিজেই কিছু পরিবর্তন এনে একটি সুস্থ জীবনধারা চর্চা করা সম্ভব।

এজন্য একদিকে স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস মেনে চলতে হবে, অন্যদিকে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। খাবারের তালিকা থেকে ফ্যাট চিনিযুক্ত ক্যালরিবহুল খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। বেশি বেশি ফলমূল, শাকসবজি, ডাল, পূর্ণশস্য (যেমন: লাল চাল লাল আটা) বাদামজাতীয় খাবার ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

 

প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর

বি পি টি, এম ডি, এম পি এইচ, এম ডি এম আর, পি এইচ ডি

কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান

ফিজিওথেরাপি মেডিসিন এন্ড রি-হ্যাবিলিটেশন বিভাগ

সাফা-মারওয়া হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার

যাএাবাড়ী মোড়, ঢাকা

মোবাইলঃ ০১৬৪১৫৭৬৭৮৭, ০১৭৩৮৩৯৪৩০৯

 


Comments

Popular posts from this blog

Prof. Dr. Md. Abu Saleh Alamgir. BPT, MD, MPH, MDMR, PhD. Physiotherapy Medicine & Rehabilitation Consultant

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা, অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা এবং স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা- বি পি আর সি

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর। বি পি টি, এম ডি, এম পি এইচ, এম ডি এম আর, পি এইচ ডি - বি পি আর সি